স্বপ্ন (ইংরেজি: Dream) মানুষের একটি মানসিক অবস্থা, যাতে মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় বিভিন্ন কাল্পনিক ঘটনা অবচেতনভাবে অনুভব করে থাকে। ঘটনাগুলি কাল্পনিক হলেও স্বপ্ন দেখার সময় সত্যি বলে মনে হয়। অধিকাংশ সময় দ্রষ্টা নিজে সেই ঘটনায় অংশগ্রহণ করছে বলে মনে করতে থাকে। অনেক সময়ই পুরনো অভিজ্ঞতার টুকরো টুকরো স্মৃতি কল্পনায় বিভিন্নভাবে জুড়ে ও পরিবর্তিত হয়ে সম্ভব অসম্ভব সব ঘটনার রূপ নেয়। স্বপ্ন সম্বন্ধে অনেক দর্শন বিজ্ঞান, কাহিনী ইত্যাদি আছে।
স্বপ্ন বিজ্ঞানের ইংরেজি নাম Oneirology। কিছু স্বপ্নবিজ্ঞানীর মতে নিদ্রার যে পর্যায়ে কেবল আক্ষিগোলক দ্রুত নড়াচড়া করে কিন্তু বাকি শরীর শিথিল (সাময়িকভাবে প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত) হয়ে যায় সেই REM (Rapid eye movement, দ্রুত চক্ষু আন্দোলন) দশায় স্বপ্ন মানুষ স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এই বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে।
স্বপ্ন হল ধারাবাহিক কতগুলো ছবি ও আবেগের সমষ্টি যা ঘুমের সময় মানুষের মনের মধ্যে আসে। এগুলো কল্পনা হতে পারে, অবচেতন মনের কথা হতে পারে, বা অন্য কিছুও হতে পারে, শ্রেণীবিন্যাস করা বেশ কষ্টকর। সাধারনত মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখে, তবে সবগুলো মনে রাখতে পারে না।
স্বপ্ন নিয়ে গবেষণায় ব্যবহৃত উদ্ভাবিত যন্ত্র
১৯৪০-এর দশক থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ক্যাল্ভিন এস হল পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি স্বপ্ন সম্বন্ধীয় প্রতিবেদন সংগ্রহ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়োতে অবস্থিত কেইস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটিতে পেশ করেন। ১৯৬৬ সালে হল এবং ভ্যান দ্য ক্যাসল দ্য কন্টেন্ট এনালাইসিস অফ ড্রিমস নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। গ্রন্থে তাঁরা কোডিং পদ্ধতির মাধ্যমে এক হাজার কলেজ ছাত্রের স্বপ্নের প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন। সেখানে তাঁরা দেখিয়েছেন যে, সমগ্র বিশ্বের জনগণ সাধারণত একই ধরনের বিষয় নিয়ে স্বপ্ন দেখে। হলের পূর্ণাঙ্গ স্বপ্ন সম্বলিত প্রতিবেদন ১৯৯০ এর মাঝামাঝি সময়ে তার উত্তরসূরী উইলিয়াম ডোমহফ কর্তৃক জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়। সেখানে আরও ভিন্ন বিশ্লেষণ দেখা যায়। স্বপ্নে মানুষ অধিকাংশ সময়ই গত দিন বা গত সপ্তাহের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কিত কিছু দেখে।স্বপ্নে ভবিষ্যতের বার্তাঃ
স্বপ্ন ভবিষ্যতের বার্তা বহন করতে পারে। পতঙ্গের গুরুমস্তিষ্ক থাকে না কিন্তু পতঙ্গেরা নার্ভক্রিয়ার সাহায্যে ভূমিকম্প, সূর্যগ্রহণ, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুযোর্গের পূর্বাভাস পেয়ে থাকে। যন্ত্রের যন্ত্রনায় মানুষের মধ্যে ভবিষ্যতের পূর্বভাস পাবার শক্তিগুলো নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। ঘুমের সময় গুরু মস্তিষ্কের কর্মকান্ড স্তিমিত হয়ে গেলে স্বতন্ত্র নার্ভক্রিয়া সক্রিয় হয়ে ভবিষ্যৎ বাণী পাঠায়। “বিভূতিযোগ” চর্চা করে যোগীরা স্বতন্ত্র নার্ভক্রিয়াকে সক্রিয় করতে পারেন।দিবাস্বপ্নঃ
মানুষ সজাগ থাকলে স্বপ্ন
দেখে না। একজন সিদ্ধ পুঁরুষ ঘুমন্ত অবস্থায়ও সজাগ
থাকেন অথবা যিনি সব সময় সজাগ থাকেন তাঁকেই সিদ্ধ পুঁরুষ বলা হয়।
তাই সিদ্ধ পুঁরুষদের স্বপ্ন দেখার কথা নয়।
ইসলামে স্বপ্নের ব্যাখ্যাঃ
মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, তবে দুঃস্বপ্ন নয়। স্বপ্ন দেখা বা না দেখার বিষয়টি অবশ্য মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার একেবারেই বাইরে। স্বপ্ন দেখার পুরো বিষয়টিই নির্ভর করে মস্তিষ্কের উপর। আর তাই ঘুমিয়ে গেলে কেমন স্বপ্ন দেখবো সেটা আগে থেকে ধারণা করা বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। আর তাই চিরকালই স্বপ্ন একটি রহস্যময় বিষয় হিসেবেই মানুষের মাঝে ঘুরপাক খেয়েছে। নানান রকমের কুসংস্কারও তৈরি হয়েছে রহস্যময় এই স্বপ্নকে ঘিরে। স্বপ্ন সম্পর্কে আছে নানান রকমের মজার অজানা তথ্য। জেনে নিন তেমনই কিছু মজার অজানা তথ্য সম্পর্কে।
১) শিশুরা স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্রে সবচাইতে এগিয়ে আছে। দিনের ৭০% সময়
শিশুরা ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয়। আর এই সময়ের ৫০% সময়েই শিশুরা স্বপ্ন দেখে
কাটায়। আর এসব স্বপ্ন শিশুদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
২) ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সবাই জানতো যে পৃথিবীর সব মানুষই স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্ন ছাড়া মানুষ হতেই পারে না বলেই ধারণা করতেন সব গবেষকরা। কিন্তু খুব
অদ্ভুত একটি বিষয় ঘটে ১৯৮২ তে। ইউভাল নামের এক ব্যক্তি যুদ্ধে মাথায় ব্যাথা
পান। এরপর ডাক্তারের কাছে মস্তিষ্ক পরীক্ষা করান। গবেষকরা লক্ষ্য করেন যে
ইউভাল ঘুমের সময় স্বপ্ন দেখেন না। এভাবে দিনের পর দিন তার ঘুম পরীক্ষা করে
কোনো স্বপ্নের হদিস পান নি গবেষকরা। তখন তারা বলেন যে স্বপ্ন না দেখলে
ইউভালের স্মৃতিশক্তির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়
ব্যাঘাত ঘটবে। কিন্তু তখন থেকে আজ অবধি ইউভাল বেশ ভালোই আছেন। তিনি একজন
প্রসিদ্ধ আইনজীবি, একজন চিত্রকর এবং সুখী মানুষ।৩) আমাদের জীবনের তিনভাগের একভাগ সময় আমরা ঘুমিয়ে কাটাই। আর প্রতিদিন এর ঘুমের মাঝে আমরা গড়ে ৫টি স্বপ্ন দেখি। প্রতিদিন ঘুমানোর সময়ে আমরা মোট ৯০ মিনিট স্বপ্ন দেখেই কাটিয়ে দেই।
৪) ঘুমানোর সময়ে আমাদের শরীরের সকল কার্যক্রম ধীর হয়ে যায়। আমাদের মস্তিষ্ক একদমই ধীর গতিতে কাজ করে, মাংসপেশি শিথিল হয়ে বিশ্বাম গ্রহণ করে, শ্বাস প্রশ্বাস ধীর হয়ে যায়। কিন্তু স্বপ্ন দেখার সময়ে শরীরের কার্যপ্রক্রিয়া প্রায় জেগে থাকার মতই সচল থাকে। বিশেষ করে মস্তিষ্ক ও শ্বাসপ্রশ্বাস জেগে থাকার মতোই স্বাভাবিক থাকে স্বপ্ন দেখার সময়।
৫) গবেষকদের মতে স্বপ্ন হলো স্মৃতির সব কিছুকে একটি টেবিলে ওলট পালট
করে ঢেলে নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার মতো একটি বিষয়। সারাদিন যা কিছু ঘটে
তার মাঝে থেকে বিশেষ কিছু স্মৃতিকে গুছিয়ে রাখতে সহায়তা করে স্বপ্ন। আর
তাই যারা বেশি স্বপ্ন দেখেন তাদের স্মৃতিশক্তিও অপেক্ষাকৃত ভালো থাকে
অন্যদের চাইতে।
৬) পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যেই স্বপ্নটি সবচাইতে বেশি দেখে থাকেন তা হলো
হঠাৎ পড়ে যাওয়ার স্বপ্ন। এমন স্বপ্ন দেখে নিশ্চয়ই আপনিও চমকে ঘুম থেকে উঠে
গেছেন অনেকবার? এছাড়াও আরো কিছু সাধারণ স্বপ্ন আছে যেগুলো প্রায় সব মানুষই
বিভিন্ন সময় দেখে থাকেন। এক নজরে দেখে নিন তালিকাটি।ইসলামের দৃষ্টিতে স্বপ্ন
স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা বিশেষজ্ঞ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সীরিন রহ. বলেছেন :
الرؤيا ثلاث : حديث النفس ، وتخويف الشيطان ، وبشرى من الله .
(رواه البخاري في التعبير)
স্বপ্ন তিন ধরনের হয়ে থাকে। মনের কল্পনা ও অভিজ্ঞতা। শয়তানের ভয় প্রদর্শন ও কুমন্ত্রণা ও আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সুসংবাদ। (বর্ণনায় : বুখারী)
ইসলামে স্বপ্নের একটি গুরুত্ব আছে। নি:সন্দেহে এটা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক চোখা বস্তুবাদীরা বলে থাকে, মানুষ যখন ঘুমায়, তখন তার মস্তিস্ক তার স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করে। যাচাই-বাছাই করে, কিছু পুনর্বিন্যাস করে। তারপর স্মৃতির ফাইলে যত্ন করে রেখে দেয়। এই কাজটা সে করে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন। মস্তিস্কের এই কাজ-কর্মই আমাদের কাছে ধরা দেয় স্বপ্ন হিসেবে।” কথাটা শুনতে মন্দ নয়। তবে এটি স্বপ্নের একটি প্রকার মাত্র। বাকী দু প্রকার কি আপনাদের মস্তিস্কে ধরা পড়ে? ইসলাম তো বলে স্বপ্ন তিন প্রকার।
হাদীসে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাজের পর মুসল্লীদের দিকে মুখ করে বসতেন। প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, গত রাতে তোমাদের কেউ কি কোনো স্বপ্ন দেখেছ? আল-কোরআনে নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্বপ্ন, ইউসুফ আলাইহিস সালামের স্বপ্নের কথা উল্লেখ আছে। ইউসূফ আলাইহিস সালামের সময়ে মিশরের বাদশার স্বপ্ন, তাঁর জেলখানার সঙ্গীদের স্বপ্ন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্বপ্ন নিয়ে তো আল কোরআনে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।
মিশরের বাদশা তার সভাসদের স্বপ্ন বিশেষজ্ঞদেরকে নিজ স্বপ্ন সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। জানতে চেয়েছিল, সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা। তারা বলেছিল, এটা এলোমেলো অলীক স্বপ্ন। তারা এর ব্যাখ্যা দিতে পারল না। নবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন। নিজের পক্ষ থেকে নয়। আল্লাহ তাআলার শিখানো ইলম থেকে। (সূরা ইউসূফের ৩৬ থেকে ৪৯ আয়াত দ্রষ্টব্য)
স্বপ্ন দ্রষ্টার অবস্থা ভেদে একই স্বপ্নের ব্যাখ্যা বিভিন্ন রকম হতে পারে। স্বপ্ন তিন প্রকার: এক. মনে মনে যা সারাদিন কল্পনা করে তার প্রভাবে ঘুমের মধ্যে ভাল-মন্দ কিছু দেখা। এগুলো আরবীতে আদগাছু আহলাম বা অলীক স্বপ্ন বলে। দুই. শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রভাবে স্বপ্ন দেখা। সাধারণত এ সকল স্বপ্ন ভীতিকর হয়ে থাকে। তিন. আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ইশারা, ইঙ্গিত হিসাবে স্বপ্ন দেখা। বিষয়টি উপরে বর্ণিত হাদীসেও উল্লেখ হয়েছে।
হাদিসে এসেছে
عن أبي قتادة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: “الرؤيا الصالحة من الله، والحلم من الشيطان، فإذا رأى أحدكم ما يحب فلا يحدث به إلا من يحب. وإذا رأى ما يكره فليتعوذ بالله من الشيطان، ولينفث عن شماله ثلاثاً، ولا يحدث بها أحداً فإنها لن تضره” متفق عليه.
আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ভাল ও সুন্দর স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে আর খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। যদি কেউ ভাল স্বপ্ন দেখে তাহলে তা শুধু তাকেই বলবে যে তাকে ভালোবাসে। অন্য কাউকে বলবে না। আর যদি স্বপ্নে খারাপ কিছু দেখে তাহলে শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে। ( বলবে, আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম) এবং বাম দিকে তিনবার থুথু নিক্ষেপ করবে। আর কারো কাছে স্বপ্নের কথা বলবে না। মনে রাখবে এ স্বপ্ন তার ক্ষতি করতে পারবে না। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. ভাল স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে।
দুই. খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে এসে থাকে।
তিন. খারাপ স্বপ্ন দেখলে সাথে সাথে তিনবার বাম দিকে থুথু ফেলে আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম বলতে হবে। তবে সত্যিকার থুথু ফেলবে না। মানে মুখ থেকে পানি নির্গত হবে না। শুধু আওয়ায করবে। কেননা হাদীসে নাফাস শব্দ এসেছে। যার অর্থ এমন হাল্কা থুথু যাতে পানি বা শ্লেষ্মা নেই।
চার. এই আমলটুকু করলে খারাপ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না।
পাঁচ. খারাপ স্বপ্ন দেখলে কারো কাছে তা বর্ণনা করবে না।
ছয়. ভাল স্বপ্ন দেখলে তার কাছেই বর্ণনা করবে যে তাকে ভালোবাসে। শত্রু ভাবাপন্ন বা হিংসুক ধরনের কারো কাছে ভাল স্বপ্নও বর্ণনা করতে নেই। কারণ, হতে পারে ভাল স্বপ্নটির একটি খারাপ ব্যাখ্যা সে শুনিয়ে দেবে। ফলে অস্থিরতা, দু:চিন্তা ও উদ্বেগ বেড়ে যাবে।
আব্দুল্লাহ শহীদ আ: রহমান
স্বপ্ন সম্পর্কে সকল তথ্য ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত।।
ভালো লাগলে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন।।
No comments:
Post a Comment